বইয়ের নামঃ কড়ি দিয়ে কিনলাম
লেখকের নামঃ বিমল মিত্র
দুই খণ্ডে’র বৃহত্তম গ্রন্থ,কড়ি দিয়ে কিনলাম “বিমল মিত্র, প্রকাশনাঃ মিত্র ও ষোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
প্রথম প্রকাশঃ মাঘ ১৩৬৮
ষড়বিংশ মুদ্রণ, পৌষ ১৪২০
পুনর্মুদ্রণঃ জানুয়ারি, ২০১৬
১৩৭০ সনের রবীন্দ্র-পুরস্কার প্রাপ্ত।।
ধরনঃ সামাজিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক উপন্যাস
অঘোরদাদু দীপুকে সবসময় বলতো,
টাকা কড়ি দিয়ে কি না হয় রে, মুখপোড়া! বড় হলে বুঝবি,কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়,সব…।
অঘোর দাদুর এই কথা’টি কি তাহলে প্রমাণ করে কড়ি মানেই জীবনের সুখ।মানুষ কড়ি দিয়ে সব কিছু কিনতে পারে? না কড়ি ছাড়াও মানুষ আনন্দ সুখ পেতে পারে।তেমনি কড়ি দিয়ে কিনলাম উপন্যাসে লেখক লিখেছেন, দেশের বিপুল পরিবর্তন ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিস্থিতি। তীব্র আদর্শবোধ থেকে গভীর সত্যপরায়ণ এবং সংসার ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জর্জরিত কিছু মানুষের আহাজারি । নতুন ব্যবস্থায় স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার ঘনিয়ে তুলা মিঃ ঘোষাল,হোসেন ভাই, ও ছিটে-ফোঁটাদের দলে ভারি হয়ে যাওয়া তখনকার সময়। এমন বাস্তবতা ও একদল মানুষের আকুতির মধ্য দিয়ে লেখক নির্মাণ করেছে এই উপন্যাস।যা মানুষ’কে ভাবিয়ে তুলেছে এবং প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে কড়ি দিয়েই কি সব কেনা যায়?
কাহিনী সংক্ষেপ
বিপত্নীক অঘোরদাদু বর্ণে-পেশায় ব্রাহ্মণ।তাদের বাড়িতে আশ্রিতা দিপু ও তার মা। অঘোরদাদুর বাড়িতেই ভাড়াটে হয়ে আসা লক্ষ্মীদি ও তার বোন সতী।এদের নিয়ে বেড়ে উঠা উনিশে একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলি লেন। রাষ্ট্রনৈতিক আর সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যবিন্দু নায়ক দীপঙ্কর। তার ব্যাক্তিজীবনে এক দিকে জাতীয় দুর্যোগ, অন্যদিকে যুগ-যন্ত্রণার প্রতিনিধি সতী-লক্ষীদির দল। তেত্রিশ টাকার ঘুষে চাকরি হয় তার। নিষ্ঠাগুণে একদম উচ্চপদে চলে যায় একদিন।তার এই অবস্থানে অফিসে ফিসফাস শুরু হয়, “রবিনসন সাহেবের কুকুরকে বিস্কিট খাইয়ে সেন সাহেবের এ প্রমোশান!” শুরু হয় আরেক লণ্ডনফেরত অফিসার মিঃ ঘোষালের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ। কিন্তু এসবের কিছুই দিপুকে কষ্ট দেয় না, যতটা মনঃপীড়া সে পায় তার ‘তেত্রিশ টাকার ঘুষ’-এর কথা মনে পড়লে। রেল-অফিসের দুর্নীতির শিকার গাঙ্গুলীবাবু যখন দারিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, তখন দীপঙ্করের মন কেঁদে উঠে। প্রাণবন্ধু কিরণ যখন স্বদেশের টানে নিরুদ্দিষ্ট হয়, তখন তার বিধবা অসহায় মা-কে সাহায্য করবার জন্য দিপু ছুটে যায়। তখনও দীপঙ্কর সেই পুরোনো প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজে।কড়ি দিয়ে কি কেনা যায় আসলে?
এত ভালো ঘরে বিয়ে হয়েও তো সতী ভালবাসা পায়নি! এত ক্ষমতা থাকার পরও তো এতটুকু সুখ পায়নি লক্ষীদি! মিস্টার ঘোষলরা কেন অসৎ হয়, এত থাকার পরও হোসেন ভাই বা নির্মল পালিতরা আরো চায়! দীপু জীবনভর খুঁজেও এসব প্রশ্নের উত্তর পায়নি।এরপর আবার ও দিপুর জীবনে ফিরে আসে সতী। যখন শাশুড়ির দাপট, মিঃ ঘোষালের মত ধুরন্ধর ব্যক্তির হিংস্র থাবার মুখোমুখি সতী। তখন শুরু হয় আরেক দ্বন্দ্ব। অদ্ভূত এই দিপু-সতীর ভালোবাসা! কত আঘাত, কত কষ্ট। তবুও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা কখনো মুখ ফুটে বলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন জাপানিরা কলকাতায় বম্বিং করে চলেছে, সেই ধ্বংসাত্মক রাতেও তাদের মধ্যকার প্রেম কেবল সৌজন্যতায় আটকে থাকে। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও দিপু সতীকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। একবার নয়, বারবার … …।
কিন্তু সতী তার পরম মৃত্যু দিয়েই দিপুর সব প্রশ্নের উওর দিয়েছে।সতী তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে কড়ি দিয়ে জীবন কেনা যায় না।কড়ি দিয়ে মৃত্যু কেনা যায় শুধু….
এই উপন্যাসের বাল্মীকির রামায়ণের সীতার মতই দুর্দান্ত চরিত্র ছিল সতীর। যাকে ঘিরেই ছিল তখনকার এত দ্বন্দ্ব। সতীর বিয়ে হয় ধনবান এক পরিবারে যেখানে নয়নরঞ্জিনী দাসী সতীর শাশুড়ি আর বর সনাতনবাবু। যাঁর বই পড়াই ছিল সব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার বহু আগেই অ্যাডলফ হিটলারের সম্পর্কে জানাশোনা ছিল তাঁর – এমনই ছিল তাঁর জ্ঞানের বাহার।সতী’র গোপন আশ্রয় কিংবা নিজের একটা ঘর ছিল দিপু। যাকে সুখি দেখার জন্য দিপুর এত আয়োজন। কিন্তু সতী অথবা দিপু কেউ কাউকে কোনদিন বলা হয়ে উঠেনি না বলা কথা’টা। সতীর সাথে সখ্যতা কিংবা সতীর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করাই ছিল দিপুর এক জীবনের পাওয়া।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
গল্পটা শুরু হয় এক বালকের জীবনে কৈশর ও যৌবনের মধ্যবিত্ত সময়ের থেকে,যেখানে তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে কিছু সুখি-অসুখি মানুষ। সেখানে তখন চলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিস্তার ও স্বদেশী আন্দোলন। যার সুযোগে মিলিটারি কনট্র্যাক্টের মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া কিছু লোক ও সংসার নামক এই মঞ্চে অঘোর ভট্টাচার্যের মত যজমানদের ঠকিয়ে আনা টাকা কড়ি।যা ছিল এই উপন্যাসের মুল আক্ষেপ।খুব খাপছাড়া গল্প তাই না? এই খাপছাড়া আবেগগুলোকে একসুতোয় বাঁধতে হলে বইটাতে একবার ডুব দিতে হবে! সতীর জন্য কাঁদতে হবে, লক্ষীদির জন্য করুণা করতে হবে, সনাতন বাবুকে শ্রদ্ধা আর মি. ঘোষালকে ঘৃণা করতে হবে।তারপর দীপঙ্করকে ভালোবাসতে হবে, খুব ভালোবাসতে হবে। দীপঙ্করের সাথে ঘুরে ঘুরে ‘মানুষ’ খুঁজতে হবে।
চরিত্র বিশ্লেষণ
এই উপন্যাসে রয়েছে অজস্র চরিত্রের সমাহার । কেউ বৃদ্ধ,কেউ বা মধ্যবয়সী,কেউ চাকরিজীবী, কেউ স্বদেশি আবার কেউ এত কিছু থাকার পরও ভীষণ অসুখি।ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে’র মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এরা কোথায় যেন আটকে রয়েছে।এদের সকলে’র মধ্যে’ই ছাড়িয়ে গেছে আনন্দ সুখহীন জীবনের গল্প।
শিক্ষণীয় লাইন
জীবন শুধু জীবনই নই,দুঃখ শুধু দুঃখ নয়,আনন্দ শুধু আনন্দ নয়,জীবনেরও একটা অন্য অর্থ আছে,দুঃখেরও একটা অন্য ব্যাখা আছে,আনন্দেরও একটা অন্য উদ্দেশ্য আছে!
লিখেছেন,
তন্নী আক্তার