চিপকো আন্দোলন
পরিবেশকে সুস্থ রাখতে প্রচুর আন্দোলন এখন পুরো পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। তবে এই আন্দোলন এই শতকেই হচ্ছে এমন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এর যাত্রা শুরু হলেও এ যাত্রার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো চিপকো আন্দোলন।
হিন্দিতে ‘চিপকো’ শব্দের অর্থ ‘জড়িয়ে ধরা’ বা ‘আটকে থাকা’। গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছ কাটতে না দেয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালে এই আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম ‘চিপকো আন্দোলন’। গাছ ও বন রক্ষার জন্য গাছকে জড়িয়ে ধরে এই অহিংস আন্দোলনটি হয়েছিলো ভারতের উত্তরাখণ্ডে।
আমরা প্রায়সই দেখে থাকি বাবা সন্তানকে মারতে এলে মা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই হয়তো ভালোবাসাকে রক্ষা করতে এমন শেল তৈরি করেন মায়েরা। স্বভাবগত এই বৈশিষ্ট্যটি আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৩ সালে পরিবেশ রক্ষায় সকল আন্দোলনকে বেগবান করেছে।
স্বাধীন ভারতের উত্তরাখণ্ডে এই আন্দোলনটি শুরু হয়। সেখানে কারখানা স্থাপনের জন্য তৎকালীন আমলারা সর্বমোট ১০০ টি গাছ কাটতে উদ্যোগী হয়। তখন এ কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ান গ্রামের দুই যুবক- সুন্দরলাল বহুগুনা ও চণ্ডীপ্রসাদ ভট্ট। তারা গাছকে জড়িয়ে ধরে গাছ কাটতে বাধা দেন। এই বিরোধিতার একটাই লক্ষ্য ছিলো; যেভাবেই হোক বনের গাছ কাটা বন্ধ করে পরিবেশকে রক্ষা করা।
পটভূমি
মূলত এ আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয় আরো দুই শতাব্দী আগে। অমৃতা দেবীর হাত ধরে এই আন্দোলনের সূত্রপাত। তিনি রাজস্থানের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা। তিন সন্তানের জননী এই নারী রুখে দাঁড়ান রাজার বিরুদ্ধে।
তখন ১৭৩০ সাল। রাজস্থানের প্রত্যন্ত অঞ্চল খেজারিলি গ্রামে একটি রাজপ্রাসাদ গড়ার পরিকল্পনা করলেন তৎকালীন মেওয়ারের রাজা। রাজার নাম অভয় সিং। রাজার নেতৃত্বেই শুরু হয় গাছ কাটা কর্মসূচী। আর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান অমৃতা দেবী। তার পাশে সে সময় তার সাথে যোগ দেন গ্রামের বিষ্ণোয়ই সম্প্রদায়ের লোকেরাও। তাদের একটাই উদ্দেশ্য, যে করেই হোক গ্রামের খেজরি গাছগুলোকে বাঁচাতে হবে। আর সেজন্য গাছের সাথে নিজেকে চেপে রেখে শুরু হয় এ আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ। তাদেরকে গাছের কাছ থেকে না সরাতে পেরে এভাবেই গাছকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই রাজার সৈন্যরা তাদের হত্যা করে।
১৯৬৩ সালে পরবর্তীতে চীন-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর ভারতের উত্তরাখণ্ডে এ আন্দোলন আবার শুরু হয়। যুদ্ধের জন্য নির্মিত রাস্তা সহ বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য ভারতের উত্তারঞ্চল বিদেশি সংস্থাদের বেশ নজর কেড়েছিল। সংস্থাগুলো চেয়েছিলো ঐ অঞ্চলের বনজ সম্পদ দখল করতে। এজন্য সরকারের অনুমতিও পেয়ে যায় আর শুরু হয় বৃক্ষনিধন। কিন্তু জীবনধারণের প্রয়োজনেও বনজ সম্পদের ১০ শতাংশও ভোগ করতে পারতো না অঞ্চলের আদিবাসীরা। অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষনিধনের ফলে কৃষির ফলন কমে যাওয়া, মাটি ক্ষয়, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছিল সমগ্র অঞ্চলটির ওপর। যার ফলাফল ছিল গ্রামবাসীদের জন্য হুমকিস্বরূপ।
১৯৭৩ সালে উত্তরপ্রদেশ থেকে এই আন্দোলন কঠোর রূপ ধারণ করে। আন্দোলনটির প্রথম সূত্রপাত হয় উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলায়, পরে তা দ্রুত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭৪ সালে সরকার কর্তৃক একযোগে ২,০০০ গাছ কাটা হলে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সুন্দরলাল বহুগুনা গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারী, পুরুষ, ছাত্রদের একযোট করেন এবং এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। ১৯৭২-৭৯ সালের মধ্যে দেড় শতাধিক গ্রাম এই চিপকো আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল।
ফলাফল
উত্তরাঞ্চলের এই প্রতিবাদের খবর রাজধানীতে গিয়ে পৌঁছালে তৎকালীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হেম্বতি নন্দন বহুগুনা একটি কমিটি গঠন করেন, যা শেষপর্যন্ত গ্রামবাসীর পক্ষে রায় দেয়। এরপর ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসলে তিনি ১৫ বছর হিমালয় অঞ্চলে গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। হিমালয় প্রদেশ , কর্ণাটক, রাজস্থান, পশ্চিমঘাটেও পরে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলায় এবং এক দশকের মধ্যে হিমালয় জুড়ে সবুজের জন্য এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের পরিবেশ সংক্রান্ত একটি কর্মসূচীর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, চিপকো কর্মীরা আমলাতন্ত্রের হাত থেকে তাদের বনজ সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছিল এবং পরে ১৯৮৩ সালে কর্ণাটক রাজ্যে এপিকো আন্দোলনকেও (একইরকম পরিবেশবাদী আন্দোলন) অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
নারীদের অবদান
চিপকো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় একজন নারীর হাত ধরে। পরে আরো নারী গ্রামবাসীর ব্যাপক অংশগ্রহণ হয় এবং শেষ পর্যন্ত নারীদের অগ্রনী ভূমিকা ছিলো। এ অঞ্চলের কৃষির সাথে নারীরা অধিক যুক্ত থাকায় তারা এই বিক্ষোভে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে এই নারীরা তাদের স্থানীয় বন রক্ষার্থে সমবায় সংগঠন গড়ে তোলেন। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীও শুরু করেন তারা।
ভারতের মতো একটি পিতৃতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা থেকে গিয়ে নারীরা যেই অগ্রনী ভুমিকা রেখেছে য়া শুধু মাত্র ভারত নয় সারা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছে এবিং এখনো করে যাচ্ছে। নারীরা যে কোনো অংশে কম নয় বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা অধিক কাজ করতে পারে এবং প্রয়োজনে তারা সকল কাজই করতে পারে, এটি আবারও প্রমাণ করেছে চিপকো আন্দোলন। এ আন্দোলনের সাথে অসংখ্য নারী যুক্ত ছিলেন যাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- গৌড়া দেবী, সুদেশা দেবী, বাচ্চনি দেবী, চণ্ডী প্রসাদ ভট্ট, ধুম সিং নেজি, শমসের সিং, গোবিন্দ সিং রাওয়াত প্রমুখ।
পরিবেশ রক্ষার্থে গাছের সাথে নিজেকে আটকে রেখে যারা রক্ত ঝরিয়েছেন, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, তাদের মনে রাখবে সকল পরিবেশবিদ। তাদের এই আত্মত্যাগ সকল আন্দোলনকারীদের সাহস ও প্রেরণা যোগাবে ভবিষ্যতে।
লিখেছেন,
নাজমুন নাহার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়