কয়েক শতাব্দী ধরে চীন বিশ্ব রাজনীতির চক্রান্ত থেকে দূরে থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝের কিছু আগে তা বদলে যায়। শুরটা হয় চীনে ইউরোপীয়ানদের বাণিজ্য অধিকার নিয়ে এবং তা ক্রমাগত ধাবিত হয় একটা পরিপূর্ণ যুদ্ধের দিকে এবং চীনাদের জন্য সূচনা হয় এক অপমানের শতাব্দী। যুক্তরাজ্য এবং চীনের মধ্যে সংগঠিত এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘ওপিয়াম ওয়্যার’ নামে পরিচিত এবং তার পরিসমাপ্তি ঘটে ‘নামকিং সন্ধি’ এর মাধ্যমে।
.
চীন এবং ইউরোপের মাঝে নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হয় সেই ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের আগমনের মধ্য দিয়ে। চীন তখন সিল্ক এবং পোর্সেলিন সামগ্রীর জন্য বিখ্যাত। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটে এবং চীনের এই সব জিনিস সেখানে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এগুলোর ব্যবসাও ছিল বেশ লাভজনক। কিন্তু ব্রিটেনের কাছে তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিল চীনের চা। তাই যুক্তরাজ্যও এখানে বাণিজ্যের ব্যাপারে উন্মুখ। কিন্তু এই বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুইটা প্রধান সমস্যা ছিল।
১। ইউরোপিয়ান বণিকরা সরাসরি চীনের বাজারে ঢুকতে পারতো না। তাদের প্রবেশ ক্যান্টন শহরের বাইরে বণিকদের জন্য নির্ধারিত জায়গার (মার্চেন্ট’স কোয়ার্টার) মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যে কোন বাণিজ্যের জন্য মিডল ম্যান হিসেবে চায়নিজদের দরকার হতো। এরা কোহং হিসেবে পরিচিত ছিল এবং এর জন্য তারা উচ্চমূল্য দাবী করতো।
২। চায়নিজরা শুধুমাত্র রৌপ্যের মাধ্যমে দাম গ্রহণ করতো যেখানে ব্রিটিশতা ব্যবহার করতো স্বর্ণ। আবার, এ ব্যাপারে ইউরোপিয়ানদের কিছু করারও ছিল না। কারণ ইউরোপিয়ান পণ্যে চায়নিজদের খুবই সীমিত আগ্রহ ছিল। তাই বাণিজ্যের স্বার্থে ব্রিটিশদের অন্য দেশ থেকে রৌপ্য কিনে চীনে সাথে বাণিজ্য করতে হতো। যার ফলে সৃষ্টি হতো ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি।
বাণিজ্য ঘটতি নিরসনে কি করা যায় তাহলে? কি দিয়ে করা যায় এই সমস্যার সমাধান? সে চিন্তা থেকেই ব্রিটিশদের মনে আসে অপিয়ামের বা আফিমের কথা। ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত ভারতে প্রচুর আফিম উৎপাদিত হতো সেসময়। আর আফিম ছিল চীনে অত্যন্ত জনপ্রিয়। চাইনিজরা প্রায় অষ্টম শতক থেকে আফিমের সাথে পরিচিত। পপি থেকে উৎপাদিত এই আফিম প্রথম দিকে শুধুমাত্র চেতনা নাশক অথবা কামোত্তেজক ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীতে পর্তুগিজরা তামাকের ব্যবহার শুরু করার পর চায়নিজরা দুটোই একসাথে আনন্দের জন্য নেশা হিসেবেও ব্যবহার শুরু হয়।

১৮ শতকের শেষদিকে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে এবং বৃটিশরাও চায়নার জন্য ভারতে এর ব্যাপক উৎপাদন করতে থাকে। অন্যদিকে চায়নার সরকার আফিম ব্যবসা বার বার বন্ধ করার চেস্টা করতে থাকে। তারপরও বৃটিশরা চোরাকারবারী এবং লোকাল কিছু নীতিহীন লোকজনের মাধ্যমে চীনে সেগুলো পাচার চালিয়ে যেতে থাকে। ১৮৩০ সালের মাঝে রৌপ্য মূদ্রার বিনিময়ে হাজার হাজার টন আফিম তারা পাচার করে। ফলে চীনেও আসক্ত লোকের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ মিলিয়ন।
তাই ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনা সম্রাট দাওগুয়াং লিং জেক্সু নামের একজন কমিশনার কে এর সমাধান কল্পে ক্যান্টনে প্রেরন করেন। লিন আফিম রপ্তানি অথবা আমদানির সাথে জড়িতদের জন্য মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করেন। সে মার্চেন্ট’স কোয়ার্টার থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন বৃটিশ পাউন্ড মূল্যমানের ১০০০ টন আফিম আটক করে এবং ১৮৩৯ সালের মে মাসে ধ্বংস করে। বৃটিশ বণকিকেরা এর জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করে কিন্তু চীন সরকার তা দিতে নারাজ। এ নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক চলে। গ্ল্যাডস্টোন নামে এক তরুণ চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দাবী করে। বৃটিশ পার্লামেন্টও ১৮৪০ সালের এপ্রিলে চীনে যুদ্ধ জাহাজ পাঠাতে সম্মত হয়। এই ফ্লীট বৃটেনের পক্ষ থেকে চীনের কাছে অপিয়ামের ক্ষতিপূরন দাবি, কোহং প্রথার বিলুপ্তি এবং তাদের বেইজ বানানোর জন্য একটা দ্বীপ দাবি করবে।
জুনে তারা চীনের জলসীমায় পৌছে এবং সম্রাটের কাছে তাদের দাবি দাওয়া পাঠানোর জন্য পার্ল নদী অবরোধ করে। জুলাইয়ের ৬ তারিখে দখল করে নেয় একটা দ্বীপ। যুদ্ধ করতে করতে তারা আগাতে থাকে। দখল করতে থাকে একের পর এক বন্দর। বৃটিশ সৈন্যরা ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। তাই কোনমতে পেরে ঊঠছিল না চাইনিজ সৈন্যরা। হেরেই যাচ্ছিল তারা। কিন্তু মিলিটারি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের পরাজয়ের খবর ও রাজাকে দিতে অনিচ্ছুক। তাই আসল খবর পাবার পরিবর্তে রাজা পেতে থাকলেন বানানো বিজয়ের খবর।
যাইহোক, চলতে থাকে যুদ্ধ এবং ব্রিটিশরা দখল করে নিতে থাকে একের পর এক শহর ও বন্দর। সবচেয়ে বড় আক্রমণটা হয় জেনজিয়াং-এ। প্রচুর মানুষ মারা যায় এবং ধ্বংস হয়ে যায় শহরের বেশিরভাগ অংশ। চীন সরকার এরপরই প্রকৃতভাবে অবস্থার তীব্রতা বুঝতে পারে এবং শান্তির আহ্বান জানায়। সে অনুযায়ী ১৯৪২ সালের ২৯ আগস্ট নানকিং/নানজিং চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে –
- ইংরেজরা চীনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ মোট ২১ মিলিয়ন রোপ্য মূদ্রা লাভ করে।
- ক্যান্টনে কো হং এর একচেটিয়া বাণিজ্যিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।
- নিংকো, অ্যাময়, ফুচাও, ক্যান্টন, সাংহাই এই পাঁচটি বন্দর ইংরেজদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আরও বলা হয় যে, ইংরেজ কনসাল্ট বনিক এবং তার পরিবারবর্গ এই অঞ্চলে বসবাস করতে পারবে।
- ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান প্রতিরাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করবে।
- হংকং এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ইংরেজদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়।
- ইংরেজ ও চীনাদের মধ্যে সরকারি চিঠি পত্রের ব্যাপারে সমতা স্বীকৃত হয়। চীনাদের কাছে ব্রিটিশ সরকার সব থেকে বেশি সুবিধা রাষ্ট্রের স্বীকৃত পায়।
- চীন বিদেশী পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করবে ঠিক হয় এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই এর পরিমাণ নির্ধারিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
এর ফলে শেষ হয় ফার্স্ট ওপিয়াম ওয়্যার বা প্রথম আফিম যুদ্ধ। যদিও চীন তাদের ইতিহাসে এটাকে প্রথম অসম সন্ধি হিসেবেই অভিহিত করে। এই সন্ধির দ্বারা চিনে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ প্রবলতর হয়| এই যুদ্ধ আফিম যুদ্ধ নামে পরিচিত হলেও নানকিং এর সন্ধিতে আফিম ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট কারণের বিষয়ের উল্লেখ না থাকায় ইংরেজ বণিকরা আফিমের ব্যবসা চালাতে থাকে| যার ফলে চীনের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের চরিত্রের অবনতি ঘটে| চীনের ৫ টি বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং কোহং বনিক গোষ্ঠীর একচেটিয়া বাণিজ্য লুপ্ত হয়| ব্রিটেনের এই যুদ্ধ সৃষ্টির দুটি উদ্দেশ্য ছিল, যথা- চীনে বাণিজ্যিক স্বাধীনতা লাভ ও চীনের দ্বারা উন্মুক্তকরণ সিদ্ধ হয়| অন্যদিকে বিদেশী পণ্যের অবাধ প্রবেশের ফলে চীনের কুঠির শিল্প ও কৃষি নির্ভর অর্থনীতির ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বৃদ্ধি পায় বেকারত্ব।
লিখেছেন,
মোঃ মাহমুদুন্নবী
Bangabandu Sheikh Mujibur Rahman Maritime University